সূচনা - মানুষের মন আর দেহ সব সময় চাহিদার বিপরীতে অবস্থান করে। এই যে আপনি লিখাটা পড়ছেন আপনারও মনে হয়তো জীবনের কোন একটা সময়ে পাখি হয়ে উড়ে যেতে মনে হয়েছে তাইনা? সব সময় আপনার মন এক যায়গায় থাকে না সে পাখি হয়ে দিবানিশি উড়ে বেড়ায় যাকে আবার লালনের ভাষায় আপনি নিজেই শেকল পড়াতে চান তাইনা? কিন্তু অপর দিকে আপনার শরীর নিয়ে সর্বদাই পাখি হয়ে উড়ে বেড়াতেও চান অর্থাৎ আপনার মনকে আপনি শেকল পড়াতে চান আবার শরীরকে পাখি হয়ে উড়ে যাওয়ার মত প্রস্তুত করতে চান। এই যে আপনার এবং আমার বিপরীতমুখী অবস্থান যা সময়েই আমাদেরকে বিভ্রান্ত করে তা থেকে মুক্তি পাবার উপায় কি? হয় আপনি পাখি হবেন অথবা আপনি পাখি হবেন না! পুরো পোষ্টটি পড়লে হয়তো আপনার এই সিদ্ধান্ত বা আপনার উড়ে বেড়ানোর চিন্তায় একটু হলেও শিকল পড়াতে সক্ষম হবে
{getToc} $title={ Table of Content }
আদৌ পাখিদের উড়তে ভালো লাগে?
আপনাকে যদি একটা প্রশ্ন করি যে, পাখিদের কি উড়তে ভালো লাগে? পাখিরা যে আকাশে উড়ে বেড়ায়, এই উড়ে বেড়ানো বিষয়টা কি সত্যিকার অর্থে পাখিদের সুখ দেয়? আপনি উত্তরে বলতে পারেন অদ্ভুদ প্রশ্ন তো! তাইনা? আমরা তো মানুষ! আমাদের পক্ষে কিভাবে সম্ভব পাখিদের উড়তে ভালো লাগে কি লাগে না? কিংবা তারা যে আকাশে দিবা-নিশি উড়ে বেড়ায় এই বিষয়টা তাঁদের আসলেই সুখ দেয়। এটা তো আমরা বুঝতে পারবো না, উপলব্ধি করতে পারবো না কারন আপনি আমি মানুষ আমরা পাখি নই। যাকগে - যদি আপনার কাছে অদ্ভুত প্রশ্ন এটা হয় অর্থাৎ পাখিদের উড়তে কেমন লাগে তাহলে এই পোষ্টের বিষয়বস্তু গুলো আরো অদ্ভুদ মনে হবে। পড়তে থাকুন -
প্রশ্নের উত্তর আগেই বলি - হ্যা! আমরা মানুষ হবার পরেও জানি পাখিদের উড়তে কেমন লাগে!
হঠাৎ পাখিরা গায়েব হয়ে যায় কেনো?
আপনি কি কখনো খেয়াল করেছেন আমাদের এই এশিয়া মহাদেশে প্রায় ৪৫-৫০ ভাগ পাখি প্রতি বছর শীতকালে গায়েব হয়ে যায়। আপনি যদি পরিবেশের দিকে তাকানোর সক্ষমতা রাখেন, পাখি দেখার সক্ষমতা রাখেন তাহলে হয়তো বুঝতে পারবেন প্রতি শীতকালে আমাদের এশিয়া মহাদেশের ৪৫-৫০ ভাগ পাখি অদৃশ্য হয়ে যায়। এই যে প্রায় ৪৫ ভাগ পাখি গায়েব হয়ে যাওয়া এটা কিন্তু দু একদিনের নয় হাজার হাজার বছর ধরে পাখিরা গায়েব হয়ে যাচ্ছে এবং পাখিরা এই কাজটি নিয়মিত করছে। এটা শুধু এশিয়ার জন্য পুরো পৃথিবীর সকল স্থানের স্থানীয় পাখিরা শীতকালে প্রায় একই সংখার বা আরো বেশি সংখ্যার পাখি গায়েব হয়ে যায় তাঁদের অবস্থানগত অঞ্চল থেকে
মানুষ যখন এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছে তাঁর শত শত বছর ধরে পাখিদের এই অদৃশ্য হয়ে যাবার উত্তর খোজার চেষ্টা করেছে। মানুষ বোঝার চেষ্টা করেছে ক্যানো আসলে পাখিরা ওই সময়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। এখন প্রশ্ন করতে পারেন কি উত্তর দিলেন বিজ্ঞানীরা? বছরের পর বছর ধরে মানুষ যে খোজার চেষ্টা করছে পাখিদের গায়েব হয়ে যাওয়া মুল কারন এর জন্য বিজ্ঞানীরা পক্ষে, বিপক্ষে কিংবা সপক্ষে কি উত্তর পেলেন। এটা নিয়ে আলোচনা করতে হলে আমাদের আরো পিছনে যেতে হবে
প্রাচীন কালের মানুষজন মনে করতো সুর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে কিন্তু এখন যদি এই কথা ক্লাস ৫ পড়ুয়া কোন শিক্ষার্থীকে বলেন তাহলে সে আপনার পিছনে লাথি মেরে চলে যাবে অথবা পুলিশের ডিম থেরাপি দিতে চাইবে আপনার নির্বুদ্ধিতা জেনে অথবা বুঝে। তবে সেরকমই মজা হচ্ছে শীতকালে পাখিদের গায়েব হওয়া নিয়ে এমন কিছু অদ্ভুদ ধারনা ছিলো প্রাচীন বিজ্ঞানীদের যেমন সতেরো শতকের বিজ্ঞানী Charles Morton বলেছিলেন শীতকালে পাখিরা চাঁদে চলে যায় এবং এই তথ্য তিনি তাঁর লেখায় প্রকাশ করেছিলেন। বিশ্বাস না হলে এখানে ক্লিক করে গিয়ে পড়ে আসুন এবং আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে বিশ শতকের শুরুর দিকের বিজ্ঞানী Carl Linnaeus বলেছিলেন শীতকালে পাখিরা ছোট ছোট জলাশয়ের পানির ভিতর লুকিয়ে থাকে। আচ্ছা আপনার কি মনে হয়? তারা ঠিক বলতেন? নাকি বোকা ছিলো?
এই যে প্রতি শীতকালে স্থানীয় পাখিদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া এটাকে এখন বর্তমান সময়ে আমরা বলি Bird Migration বা পাখির শীতযাত্রা। আমরা বাংলাদেশের মানুষজন শীতকালে বলি থাকি অতিথি পাখি আসছে তাইনা? এই যে অতিথি পাখির আসা এটাও মাইগ্রেশন জনিত কারনে ঘটে থাকে। মাইগ্রেশনের সহজ মানে হচ্ছে এক যায়গা থেকে অন্য যায়গায় চলে যাওয়া আর পাখিদের এই আচরনের মুল কারন খুজতে গেলেই বুঝতে পারবেন শুরুর দিকের প্রশ্নের উত্তর যে - সত্যি সত্যি পাখি হয়ে উড়ে বেড়ানো কি সুখের? অর্থাৎ পাখিরা কেনো এই মাইগ্রেশন করে সেটির কারন যদি আমরা খুজে বের করতে পারি তাহলে আমরা বুঝতে পারবো যে, পাখি হয়ে উড়ে বেড়ানোটা কি সত্যিকারের সুখের বা সুখকর কিনা!
পাখির শীতযাত্রা বা বার্ড মাইগ্রেশন পদ্ধতি -
মাত্র বিগত ১৫ বছরে পাখিদের এই শীত যাত্রার প্রকৃত কারন আমাদের সামনে এসেছে। কিভাবে সম্ভব হয়েছে? কারন বিগত ১৫ বছরে আমরা GPS এবং Nanotechnology আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি। বিজ্ঞানীরা শীত যাত্রার পাখিদের গায়ে Microchip লাগিয়ে দিয়েছেন এবং GPS Tracking করে বোঝার চেষ্টা করেছেন যে পাখিরা কি করে! ফলাফল যা এসেছে তা আপনার যে পাখি হয়ে উড়ে যাবার কল্পনা বা আপনার যে পাখি হবার ইচ্ছে সেই ইচ্ছের গোড়ায় ঠান্ডা জল ঢেলে দেবে।
শীত যাত্রার সময়ে পাখিরা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে রওনা দেয় এবং এর পরিণতি কি হবে পাখিরা জানেনা। পাখিরা জানেই না তারা এই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের যাত্রাপথ পাড়ি দিতে পারবে কিনা বা তারা আদৌ বেঁচে থাকবে কিনা! প্রতি বছর শীত কালের শুরুতে শুধু মাত্র ইউরেশিয়া মানে ইউরোপ এবং এশিয়া থেকে প্রায় চার'শ কোটি পাখি শীতযাত্রার মাইগ্রেশনে অংশ নেয়। এই যাত্রার মুল কারন পাখিদের শরীরের রক্ত আমাদের অর্থাৎ মানুষের রক্তের থেকে বেশি গরম। এজন্যে পাখিরা বেশি শীতে বেঁচে থাকতে পারে না আর তাই বেঁচে থাকার তাগিদে পাখিরা বেছে নিয়েছে এই কষ্টকর শীত যাত্রার মাইগ্রেশন!
কতটা কষ্টকর যদি জানেন তাহলে আপনি আর জীবনে কখনো পাখি হতে চাইবেন না। পাখিরা অধিক শীত থেকে বেঁচে থাকার জন্যে শীতকালের শুরুর দিকে হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে যায় তবে দুঃখ জনক বিষয় হচ্ছে জীবনে প্রথমবার শীত যাত্রা করা পাখিদের ভিতরে সর্বোচ্চ ৩০ ভাগ পাখি জীবিত অবস্থায় প্রথম মাইগ্রেশন শেষ করতে পারে। সহজে বললে - ১০০ টা পাখি শীত যাত্রায় অংশ নিলে তাঁর ভিতরে ৭০ টি পাখি মারা যায় এবং ৩০ টি পাখি জীবিত অবস্থায় থাকে।
শীতকাল আসার দুই সপ্তাহ আগে থেকেই প্রিপারেশন নিয়ে থাকে শীত যাত্রায় অংশ নেয়ার জন্যে। শীতকাল যে আসছে সেটা পাখিরা বুঝতে পারে এবং এর জন্যে তারা প্রিপারেশন নেয় কারন তাঁদের অনিশ্চিত যাত্রার দিকে যেতে হবে। এর জন্য দুই সপ্তাহ আগে থেকে পাখিরা দুইগুন, তিনগুন যতখানি সম্ভব বেশি বেশি খেতে শুরু করে এবং শরীরে জমা করতে শুরু করে শক্তি। প্রজাতি ভেদে পাখিরা ভিন্ন ভিন্ন যাত্রা পথে ভিন্ন ভিন্ন অনিশ্চিত গন্ত্যবের উদ্দেশে রওনা হয়। কি ধরনের গন্তব্য? আমরা জানি হিমালয় পর্বতমালার উচ্চতা ৮,৮৪৮ মিটার এবং Bar-Headed Goose নামে এক ধরনের পাখি আছে যাদের শীতযাত্রা হিমালয় পর্বতমালার উপর দিয়েও চলে যায়। বলা হয় তারা প্রায় ৯০০০ মিটার উচু দিয়ে শীত যাত্রায় পথ পাড়ি দেয়। সঠিক হিসেব পেতে এই আর্টিকেলটি পড়তে পারেন
Eurasian reed warbler নামে ছোট্ট একটি পাখি রয়েছে; শীত যাত্রার জন্যে প্রায় ৩৯৫০ মিটার উচু দিয়ে উড়তে বাধ্য হয় আর Red-backed shrike পাখির ৩৬৫০ মিটার; বিস্তারিত এখানে। ভোগলার নামে ছোট্ট পাখি আছে; শীত যাত্রার জন্যে ৪০০০ কিলোমিটার উড়তে বাধ্য হয়; যে যাত্রাপথ আমাদের দক্ষিন এশিয়াকে একবার যাতায়াত করে ঘুরে আসার প্রায় সমান।
কোন রকম যাত্রা বিরতি না নিয়েই এই ছোট্ট পাখিটি তাঁর যাতায়াত শুরু করে এবং শুরুর সময়ে সেই ছোট্ট পাখির শরীরের ওজন থাকে ২৩ গ্রাম এবং যখন যাত্রা শেষ করে মানে ৪০০০ কিলোমিটারের যাত্রা তখন তার শরীরে ওজন থাকে মাত্র ৯ গ্রাম। Arctic Tern পাখির মাইগ্রেশন পথ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হয় মানে তারা Arctic থেকে শুরু করে Antarctica পর্যন্ত যায় যার দুরুত্ব ২০০০০ কিলোমিটার। প্রতি বছর এই পাখি এতটা পথ পাড়ি দিয়ে যাত্রা করে শুধু মাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে
পাখিরা কিভাবে বুঝে তাদের যাত্রাপথ কোনটা?
প্রশ্ন হতে পারে পাখিরা কিভাবে বুঝে কোথায় যেতে হবে? অথবা তাঁদের যাত্রাপথ কোনটা? তাইনা? এর উত্তর হচ্ছে কিছু কিছু পাখির ঠোটে চুম্বকীয় কম্প্যাস থাকে। তারা দিক বুঝতে পারে। তাদের সেই চুম্বকীয় ন্যাচারাল প্রাকৃতিক শরীর বৃত্তীয় কম্পাস তাদের দিক নির্ণয়ে সাহায্য করে। কিছু কিছু পাখি সুর্য, চাঁদ এমনকি তারা দেখেও দিক নির্ণয় করতে পারে আবার কিছু কিছু পাখি তার প্রথম যাত্রাপথ চিনে নেয় সিনিয়রদের কাছ থেকে এবং সেও তাদের জুনিয়রদের কে শিখিয়ে বা পথ দেখিয়ে মারা যায়।
পাখিরা মুলত বেঁচে থাকার তাগিদে উড়তে বাধ্য হয় যেহেতু তারা পাখি হয়েছে তাদের বেঁচে থাকতে হবে এবং এই জন্যেই তারা উড়তে বাধ্য হয় এটা সুখকর কিছু নয়। তাদের এই ওড়ার সক্ষমতা আপনি আমি, আমাদের মত সুখ চিন্তা দ্বারা বাহিত হয় না। পাখির উড়াকে যেমন সুখকর মনে করি আমরা এবং উড়তে চাই কিন্তু যাদেরকে দেখে আমরা উড়তে চাই সেই পাখিদের উড়া আমাদের সুখ চিন্তা দ্বারা বাহিত হয় না। পাখির যদি আমাদের মত চিন্তার সক্ষমতা থাকতো তবে তারা পাখি নয় আমাদের মত মানুষ হয়ে এক যায়গায়, এক ঘরে, এক স্থানে স্থির থাকতে চাইতো! হয়তো এ কারনেই কবিরা বলেন - নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস ওপারে যত সুখ আমার বিশ্বাস
🔊 আমার মতামত - বিভিন্ন কারনে মনে দুঃখ নিয়ে পাখি হয়ে দূরে কোথাও উড়ে যেতে চাওয়া আপনাকে বলছি - পারতেন এত লম্বা সময় বাঁচার তাগিদে উড়তে? পারতেন এত লম্বা সময়ে না খেয়ে ৭০ ভাগ মৃত্যুর সম্ভবনা নিয়ে উড়ে যেতে, স্থান ত্যাগ করতে? আমি নিশ্চিত আপনি পারতেন না! বোর হয়ে যেতেন অথবা মরে যেতেন। আপনার মন পাখি হতে চায় আর পাখিদের মণ আপনার মত হয়তো মানুষ হতে চায় তাই মানুষ যেহেতু হয়েছেন মানুষ হয়েই থাকুন পাখি হবার চিন্তা করে পাখিদের উড়ার সক্ষমতার কষ্টকে উপহাস করবেন না। পাখিদের জীবন আপনার আমার সুখ কল্পনার দিয়ে বাহিত হয় না