সলিল চৌধুরীর গায়ের বঁধু ও সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার গান!

একবার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়ীতে এক তরুণ হাজির হয়েছেন। এর আগে দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়িতে ওই তরুণের সাথে হেমন্ত বাবুর আলাপ হয়েছিলো তবে তেমন কিছু নয়। সেদিন হেমন্ত বাবুকে ওই তরুণ বেশ কয়েকটা গান শোনালেন। গান শুনে বেশ প্রশংসা করলেন হেমন্ত বাবু এবং বললেন - এসব গান তো আর রেকর্ড করা যাবে না অন্য গান থাকে তো দাও

salil chowdhury songs

সেই মহুর্তে ওই তরুণের অন্য কোন গান মনে পড়ছিলো না। শেষে হেমন্ত বাবুর থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। সেই তরুণকে এগিয়ে দেয়ার জন্য সিড়ি দিয়ে নামছেন হঠাৎই সেই তরুণের একটা আধখানা গানের কথা মাথায় এলো সাথে সাথে সে হেমন্ত বাবুকে বললো সে কথা। দুজনেই আবার ফিরে এলেন। ওই আধখানা গান শুনে হেমন্ত বাবু বললেন - রেকর্ড করার পক্ষে এটাই ঠিক গান। তুমি এটা তারাতাড়ি শেষ করে নিয়ে এসো


এরপরে ওই তরুণের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি হয়েছে রাজনীতি করার জন্যে ফলে তিনি আত্নগোপন করলেন। সে সময় শ্যামল মিত্রের নৈহাটির বাড়িতে প্রায় সময়ই তাঁর বন্ধু-বান্ধবরা চলে আসতো। তাঁদের মাঝে কেউ সিনেমা জগতের লোকজন আবার কেউ হয়তো গানের জগতের। তো রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে সবাই ঘুমোতে গিয়েছেন। গভীর রাত! হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো একজনের

সেই একজন, চোখে মুখে অস্থিরতা নিয়ে চলে গেলেন শ্যামল মিত্রের কাছে। কি ব্যাপার? ছেলেটি বললো একটা নতুন গান মাথায় এসেছে এবং সে ঘুমের মাঝেই সেই গানের কিছু অংশও সুর করে ফেলেছেন। গানটা একবার শুনবি? ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দুই বন্ধু মিলে শুরু করলো গান তৈরি করার খেলা। সেদিনের পরে সেই তরুণ সেই গানটা শেষ করে এবং সুর করে হেমন্ত বাবুর হাতে তুলে দিলেন

হেমন্ত বাবু গানটা রেকর্ড করলেন এবং গানটির Orchestration ও করলেন তিনি নিজেই। রেকর্ডটি দুপীঠ জুড়েই গানটি রিলিজ করলো। এদিকে ওই তরুণ সুরকার, গীতিকার তখনো আত্নগোপন করেই আছেন। দিকে দিকে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়লো। বাংলা গানের জগতে এক নতুন দিক নির্দেশ হলো ওই গানের মাধমেই। গানের নাম ছিলো - গায়ের বঁধু এবং সেই তরুণ সুরকার , গীতিকারের নাম ছিলো - সলিল চৌধুরী

সুকান্তের কবিতা - অবাক পৃথিবী 

অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি


সলিল চৌধুরী এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জুটি বাংলা গানের এক নবজাগরণ। সলিল চৌধুরীর গায়ের বঁধু সত্যি সত্যি চারদিকে সাড়া ফেলে দিলো তখন এবার তিনি একটু অন্য রকমের কাজ করতে চাইছিলেন।সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায় সুর দিলেন সলিল বাবু

মহুয়া রায়চৌধুরী - রুপালি পর্দার প্রতিভাময়ী এক অভিনেত্রী

সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা যে গানে রুপ দেয়া যায় তা করে দেখালেন সলিল বাবু। প্রথমেই বেছে নিলেন অবাক পৃথিবী। এই কবিতাটি বার বার আবৃত্তি করে আত্তস্থ করে ফেললেন। কবিতাটি তে অবাক পৃথিবী বিভিন্ন ভাবে উচ্চারিত হয়েছে কখনো শ্লেষের সাথে, কখনো হতাশায় আবার কখনো বা অন্য অর্থে। গানের বেলাতেও সেই পার্থক্য বজায় রাখলেন সলিল চৌধুরী। কবিতা থেকে গানটি সুর করলেন ১৯৫০ সালে তখন IPTA তে গানটি গাইতেন দেবব্রত বিশ্বাস এবং প্রীতি সরকার। তাদের গলায় গানটা একদম অন্য মাত্রা পেত

হেমন্ত তুমি এই গানটা রেকর্ড করো - 

একদিন দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়ীতে আড্ডা চলছে; আড্ডায় হাজির হেমন্ত বাবু এবং সলিল চৌধুরী। সেই আড্ডাতে হেমন্ত বাবু গানটা প্রথম শুনলেন আর তখন দেবব্রত বিশ্বাস বললেন - হেমন্ত তুমি এই গানটা রেকর্ড করো

হেমন্ত বাবু রাজি হলেন এবং গানটা সেদিনিই তুলে নিলেন আর সে বছর ই গানটা রেকর্ড হয়ে বাজারে এলো। আবার ও সেই রেকর্ড অসম্ভব জনপ্রিয় হলো। প্রথাগত চলন ছেড়ে এক্সপ্রিমেন্টাল কাজ করেছিলেন সলিল চৌধুরী এই গানটিতে 

যেমন - শুরুতে ভৈরবী সুরের প্রভাব এসেছে অথচ যেখানে অবাক পৃথিবী অবাক যে বার বার সেখানে ভৈরবী ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়ে মেজর কর্ড বা শুদ্ধ পর্দায় এসেছে। বিশুদ্ধ বাদীরা আপত্তি তুলেছিলেন কিন্তু সে আপত্তি সলীল সংগীত জোয়ারে কখন যে ধুয়ে মুছে গেছে সেটা কেউ খেয়াল ই করেনি 

অবাক পৃথিবী কম্পোজ করার পরে হাত দিলেন অন্যতম কঠিন কাজে। সুকান্তের কবিতা রানার এ সুর দিলেন এবার। কবিতা গানে পরিনত হলো এ গান নিয়ে বিভিন্ন আলোচনায় সলিল বাবু ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে গানটির মিউজিক বানিয়েছিলেন এবং কেনো আজ ও এ গান যে কোন মিউজিক ডিরেক্টরদের কাছে বাইবেলের মত

চাহিবামাত্র ইহার বাহককে টাকা দিতে বাধ্য থাকিবে কেনো?

রানার যেখান থেকে যাওয়া শুরু করেছে, সে বিভিন্ন মাঠ, ঘাট, জঙ্গল পেরিয়ে কখনোই সে তাঁর প্রথম স্থানে ফিরে আসছে না ফলত এ গানে অস্থায়ীতে ফেরার কোন সুযোগ ছিলো না। সা এর পরিবর্তন এ গানের সম্পদ আর এভাবেই পরিবর্তন করে গন্তব্যের যায়গা বদলানো কে ইঙ্গিত করেছেন। শোনা যায়, প্রায় একমাস সময় লেগেছিলো কবিতাটা গানে সুর করতে। এতবার পড়েছেন কবিতাটা যে, কবিতাই কখন যেন গান হয়ে উঠেছে

গানেই আছে - রানার চলেছে বুঝি ভোর হয় হয় অর্থাৎ ভোর তখনো হয়নি; ব্যাবহার করলেন কোমল ধ আবার রানার রানার ভোর তো হয়েছে আকাশ হয়েছে লাল এখানে ব্যবহার করলেন শুদ্ধ ধ। কোথাও একটা মেজর কর্ড আবার কোথাও মাইনর কর্ড ব্যবহার করে বোঝালেন দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে আর এভাবেই সলিল চৌধুরী পুরো গানটা জুড়ে এক্সপ্রিমেন্ট করেছিলনে 

এ গানের সুর সলিল চৌধুরীর অন্যতম সেরা ক্রিয়েশন আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও এ গানে দিয়েছিলেন সেরাটা। আর তাইতো এ গান জেনারেশনের পর জেনারেশন একই ভাবে জনপ্রিয়

আরো পড়ুন -

🔊 শেষ কথা - এই পোষ্ট পড়ে যদি আপনার মনে হয় এখানে দেয়া কোন তথ্য ভুল আছে তাহলে কমেন্টে জানাতে পারেন। আমি আমার ভুল সংশোধন করার চেষ্টা করবো। লিখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে ❤️

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Please validate the Captcha

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম